একটি কোয়েল খামার বদলে দিয়েছে গ্রাম


পাঁচ বছরের ব্যবধানে বদলে গেছে গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার বোনারপাড়ার আব্দুল্যাহ পাড়া গ্রামের চেহারা। পাঁচ বছর আগের আব্দুল্যাহ পাড়া আর আগের মতো নেই। এখন আর কাউকে না খেয়ে থাকতে হয় না। কাজের অভাবে বেকার বসে থাকার সুযোগও নেই গ্রামের মানুষের। স্ত্রী-সন্তানকে ফেলে রেখে শহরে কাজের খোঁজে যেতে হয় না। 

গোটা গ্রামের এমন পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে ওই গ্রামের সন্তান আহসান হাবীব ও তার স্ত্রী শিউলী আহসানের কঠোর সাধনার কারণে। 

গাইবান্ধা শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দুরে সাঘাটা উপজেলার আব্দুল্যাহ পাড়া গ্রাম। গল্প শুনে স্বপ্নের মতো মনে হলেও সেই গ্রামে হাবীব ও শিউলীর হাতে গড়া কোয়েল পাখির খামার দেখলে যে কারো চক্ষু স্থির হয়। ২০০১ সালে সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর নেন আহসান হাবীব। ছোট বেলা থেকেই তার স্বপ্ন ছিল মানুষের জন্য কিছু করার। আর তাই চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর যেমন চিন্তা তেমন কাজ। ভাবতে ভাবতে গড়ে তোলেন পাখির খামার। নিজের আয় রোজগারের পাশাপাশি মানুষের কর্মসংস্থান তৈরির জন্যই মুলত তার এই উদ্যোগ। 

২০১০ সালে সাঘাটার আবদুল্লাহ পাড়ায় তৈরি করেন কোয়েলের খামার এস এগ্রো ফার্ম। পেনশন হিসেবে পাওয়া টাকা থেকে দেড় লাখ টাকা নিয়ে শুরু করেন খামারের কার্যক্রম। ৯ হাজার টাকায় তিনশ’ পাখি কিনে একটি টিন শেড ঘরে শুরু হয় তার খামারের যাত্রা। পরে তিনি বিভিন্ন ব্যাংক ও এনজিও’র কাছ থেকে দেনা করে আরো কয়েক লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন খামারে। ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিন বছর লাভের বদলে লোকসান গুনতে হয় তাকে। এরপর লাভের মুখ দেখতে থাকেন তিনি। ২০১৩ সালের জুন থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এক বছরে তার আয় প্রায় ৭০ লাখ টাকা। তিনশ’ পাখি দিয়ে শুরু হওয়া হাবীবের ওই খামারে এখন ৭০ হাজার কোয়েল পাখি রয়েছে।  

মাসে ১ লাখ ৮০ হাজার ডিম পাড়ে তার কোয়েল পাখিরা। ডিম ফোটানোর জন্য ৫০ হাজার রেখে বাকিটা বিক্রি করেন তিনি। পুরুষ পাখিগুলো প্রতিদিন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয় বিক্রির জন্য। তার এই পাখির ফার্ম পরিচালনায কাজ করছেন ২০ জন কর্মচারি। যাদের বেতন মাসে লক্ষাধিক টাকা। 

ওই এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, আহসান হাবীব এবং তার স্ত্রী শিউলীর  কোয়েল পাখির খামার। ১০ বিঘা জমির ওপর ৯টি শেড গড়ে তাতে বাণিজ্যিকভাবে খামার গড়েছেন ওই দম্পতি। প্রতি শেডে ২০ হাজার পাখির স্থান সংকুলান হয়। তিনশ’ পাখি দিয়ে শুরু করলেও চার বছরে তাদের খামারে এখন ৭০ হাজার পাখি। প্রতিদিন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে গাইবান্ধার কোয়েল পাখি ও ডিম। পাশাপাশি ফেরি করে ডিম ও পাখি বিক্রি করে এখন স্বাবলম্বী অনেক মানুষ। 

ওই গ্রামের আব্দুল খালেক বলেন, পাখি লালন পালনের জন্য হাবীব ভাইকে এখন গ্রামের সবাই পাখি হাবীব নামেই চেনেন। প্রায় প্রতিদিনই হাবীব-শিউলির খামারে দর্শনার্থীদের ভিড় থাকে। 

আহসান হাবীবের স্ত্রী শিউলি আহসান জানান, কর্মচারীদের সঙ্গে তারা স্বামী-স্ত্রী সমান পরিশ্রম করেন। এখন বিনিয়োগের পরিমাণ ৩ কোটি টাকারও ওপরে। মাসে পাখির খাবার, পরিচর্যা, কর্মচারিদের বেতনসহ ব্যয় হয় দুই লাখ টাকা। খামারে প্রায় ৯০ লাখ টাকার পাখি আছে। প্রতিদিনের আয় ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় ওই গ্রামের ৮০ জন লোক প্রতিদিন ফেরি করে পাখি ও ডিম বিক্রি করে তাদের সংসার চালান।   

কোয়েল খামারের প্রধান উদ্যোক্তা হাবিব জানালেন, ব্যক্তিগত লাভের আশায় নয়, এই খামারটি তার গ্রামের অভাবি মানুষদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য স্থাপন করা হয়েছে। গ্রামের শতাধিক নারী-পুরুষকে নানাভাবে সম্পৃক্ত করা হয়েছে এই খামারের সঙ্গে। এক সময় যাদের বেকার সময় কাটাতে হতো, এখন পাখি বেচাকেনা করে তাদের প্রতিদিনের আয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। এই টাকা তাদের জীবিকা ও ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার কাজে লাগছে। খামারে কাজ করে এবং পাখি বিক্রি করে স্বাবলম্বী হয়েছেন গ্রামের অনেকেই। আমি চাই মানুষের কল্যাণে এই গ্রাম কোয়েলের গ্রাম হিসেবে গড়ে উঠুক।

এ ব্যাপারে সাঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল আউয়াল জানালেন, আহসান হাবীবের পরিকল্পনা তাক লাগানোর মতো। সরকারিভাবে সহযোগিতা পেলে বেকার সমস্যা দূর করার পাশাপাশি আয়েরও নিশ্চয়তা দিতে পারবে তার ওই কোয়েল পাখির খামার। 

জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা আবুল কাশেম বললেন, কোয়েলের মাংস ও ডিমের পুষ্টিমাণ অনেক বেশি। কোয়েল পাখি চাষের ক্ষেত্রে শুধু সফলই নন, প্রাণি সম্পদ বিভাগের মতে আহসান হাবীব-শিউলী দম্পতি একটি মডেল। 

No comments:

Post a Comment