মহান আল্লাহর নিয়ন্ত্রণের নিদর্শন


আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘নিশ্চয়ই নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টিতে এবং দিন-রাত্রির আবর্তনে জ্ঞানীদের জন্য রয়েছে নিদর্শন।’ (সূরা আল-ইমরান, আয়াত : ১৯০)। মানুষ জ্ঞানসম্পন্ন জীব। সে যদি তার বিবেক ও জ্ঞান দিয়ে আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি লক্ষ্য করে তবে প্রতি মুহূর্তে সে পেয়ে যাবে স্রষ্টার নিদর্শন। আমাদের পৃথিবীর দিকে যদি দৃষ্টি দেই তবে দেখতে পাই পৃথিবী গোলাকার। ধরা যাক পৃথিবী একটি ফুটবলের মতো। ফুটবলের ওপর যদি কতগুলো পিপীলিকা ছেড়ে দেয়া হয় পিপীলিকাগুলো যেমনি ফুটবলের চামড়ার ওপর চলাচল করবে আমরাও তেমনি গোলাকার এ পৃথিবীর ভূ-ত্বক তথা পৃথিবীর উপর-নিচ ও পাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছি। আমরা যদি লাফ দেই তবে পৃথিবী থেকে শূন্যে উঠে যাব। এমনিভাবে কোনো আকাশ যানে করে পৃথিবী ছেড়ে মহাশূন্যের দিকে চলে যেতে সক্ষম হব। প্রশ্ন হতে পারে, গোলাকার পৃথিবীর চারদিকে যেহেতু আমরা রয়েছি পাশে যারা রয়েছে তারা তাদের ঘরবাড়িসহ কাত হয়ে হেলে যাওয়া, নিচে যারা তারা নিচের দিকে পড়ে যাওয়া থেকে কীভাবে রক্ষা পাই? জবাবে বলা যায়, একটি চৌম্বকের গোলক তার উপর নিচ পার্শ্ব যেখানেই লোহার টুকরা রাখা হয় তা পড়বে না। ঠিক তেমনি আল্লাহপাক পৃথিবীকে দিয়েছেন একটি চৌম্বক শক্তি বা মধ্যাকর্ষণ শক্তি। যার কারণে পৃথিবী সব অংশের সব বস্তুকে আঁকড়ে ধরে রাখছে। সাধারণ চৌম্বক অ্যালুমিনিয়াম বা এ জাতীয় অনেক বস্তুকে আকর্ষণ করে না কিন্তু পৃথিবী সব বস্তুকেই আকর্ষণ করে। পৃথিবীতে যে পরিমাণ চৌম্বক শক্তি দেয়া হয়েছে যদি তার চেয়ে বেশি হতো তবে আমাদের চলাচলে কষ্ট হতো, দ্রুতগামী যানবাহন আবিষ্কার কষ্টকর হতো। আর চৌম্বক শক্তি যদি কম হতো তবে চলার পথে বাতাসের ধাক্কায় হয়তো আমরা পড়ে যেতাম। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য ভূমিকে করেছেন বিছানা যাতে তোমরা তার প্রশস্ত পথে চলাফেরা করতে পার।’ (সূরা নূহ, আয়াত : ২০-২১)। যে পরিমাণ চৌম্বক শক্তি আমাদের চলাচলের উপযোগী ঠিক সে পরিমাণ চৌম্বক শক্তি পৃথিবীর ধারণ করা স্রষ্টার অন্যতম নিদর্শন। আরও অবাক করা ব্যাপার হল পৃথিবীর কিসে এ চৌম্বক শক্তি বিজ্ঞানীরা তা আবিষ্কার করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা সাধারণভাবে বলব, এটা আল্লাহর নির্দেশ বৈ অন্য কিছু নয়। যদি আরও একটু চিন্তা করি পৃথিবীকে গোলাকার করে চৌম্বক শক্তি দিয়ে আমাদের এর চামড়ার ওপর বসবাসের উপযোগী করে রেখে দিয়ে পৃথিবীর ভেতরে কী দিলেন? আমরা জানি সূর্যের কিরণে প্রতিদিন সাগর, মহাসাগর, নদীনালা থেকে বিপুল পরিমাণ পানি বাষ্প হয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে। এ পানি যদি মহাশূন্যে বিলীন হয়ে যেত তবে পৃথিবী পানিশূন্য হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহপাক পৃথিবীর চারদিকে মহাশূন্যের দিকে যেতে বাতাসের কতগুলো স্তর বিন্যাস করেছেন। একটি স্তরের বাতাস খুব ঠাণ্ডা। জলীয় বাষ্প সে বাতাসের স্পর্শে এসে ঘনীভূত হয়ে শীতকালে বাতাসের বাষ্প যেমনি কুয়াশা হয়ে বাতাসে ভেসে বেড়ায় তেমনি মেঘে পরিণত হয়। ফলে আর উপরে উঠতে পারে না। বিমানে বিদেশ যারা গেছেন এবং জানালার পাশে বসেছেন তারা দেখেছেন বিমান যখন মেঘের স্তরের উপরে উঠে যায় তখন নিচের মেঘমালাকে তুলার মতো, বরফের পাহাড়ের মতো অপরূপ সুন্দর দেখা যায়। যেখানে আল্লাহপাক বৃষ্টিবর্ষণ করাবেন সেখানে ওই স্তরের ভাসমান বাষ্পীয় কণাগুলোকে একটু বড় করে দেন। ফলে সেগুলো আর বাতাসে ভেসে থাকতে পারে না বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা কি দেখ না যে পানি তোমরা পান কর তা তোমরা মেঘমালা থেকে বর্ষণ কর না আমি বর্ষণ করি।’ (সূরা ওয়াকিয়াহ, আয়াত : ৬৯)।আমরা কি কখনও চিন্তা করেছি বায়ুস্তরের মেঘমালার ওই স্তরকে কেন ঠাণ্ডা করে রাখা হয়েছে? পৃথিবীতে বৃষ্টিবর্ষণের পর মাটির স্তরকে এমনভাবে ফিল্টারের ন্যায় করেছেন যাতে পানি মাটি ভেদ করে ধীরে ধীরে বিশুদ্ধ হয়ে গোলাকার পৃথিবীর ভেতর জমা হয়। আর আল্লাহ বাতাসকে পদার্থ করেছেন যেন পাম্প করে নলকূপের মাধ্যমে বান্দা সে পানি তুলে পান করতে পারে। শুধু তাই নয়, যানবাহন কলকারখানা চলতে হলে প্রচুর জ্বালানি প্রয়োজন। গোলাকার পৃথিবীর ভেতর রেখেছেন জ্বালানি তেল, গ্যাস ইত্যাদির খনি। যানবাহন শিল্প কারখানা তৈরিতে প্রচুর লোহা প্রয়োজন। পৃথিবীর ভেতর রয়েছে লোহার খনি। তা ছাড়া কয়লা, স্বর্ণ ইত্যাদি মানব জীবনে যত কিছুর প্রয়োজন এবং কিয়ামত পর্যন্ত প্রয়োজন হবে গোলাকার করে পৃথিবী সৃষ্টি করে তার ভেতর সবকিছু দিয়ে পরিপূর্ণ করে মানুষকে রাখলেন চৌম্বক শক্তি দিয়ে ভূ-ত্বকের উপরে। সব খনিজ সম্পদ পৃথিবীর ভেতরে অবস্থান করলেও একটি অপরটির সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে না। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি দেখবে না দয়াময় স্রষ্টার সৃষ্টিতে কোনো বৈষম্য বারবার তাকিয়ে দেখ তোমার দৃষ্টি ব্যর্থ ও পরিশ্রান্ত হয়ে তোমার দিকে ফিরে আসবে।’ (সূরা মুলক, আয়াত : ৪)। একসঙ্গে কয়েকটি ফুটবলকে লাথি মেরে শূন্যে প্রেরণ করলে যেমনি শূন্যে উঠে যাবে; তেমনি পৃথিবী, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র সবকিছু শূন্যে ভাসমান। চাঁদে গিয়ে পৃথিবীর দিকে তাকালে পৃথিবীকে একটি তারার মতো দেখা যাবে। যেমনিভাবে আমরা অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্রকে তারার মতো জ্বলতে দেখি। পৃথিবীকে শূন্যের মধ্যে সূর্য থেকে যে দূরত্বে রাখা হয়েছে যদি আরও কাছে থাকত তবে সূর্যের তাপে জ্বলে যেত। যদি বেশি দূরে রাখা হতো তবে ঠাণ্ডায় বরফ হয়ে যেত। সূর্যের দিকে পৃথিবীর যে অংশ সে অংশ আলোকিত দিন। অপর অংশে সূর্যের আলো পৌঁছতে পারে না তাই সেখানে অন্ধকার রাত। এভাবে যদি থেকে যেত তবে জীবনযাত্রা অচল হয়ে যেত। আল্লাহ পৃথিবীকে স্বীয় স্থানে ২৪ ঘণ্টায় একবার ঘুরতে নির্দেশ দিলেন (আহ্নিকগতি)। এ ঘূর্ণনের ফলে আলোর দিক অন্ধকারের দিকে অন্ধকারের দিক আলোর দিকে গিয়ে দিনরাত হচ্ছে। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ দিন ও রাতের পরিবর্তন সাধন করেন। নিশ্চয় এতে চক্ষুষ্মানদের জন্য রয়েছে নিদর্শন।’ (সূরা নূর, আয়াত : ৪৪)। অপরদিকে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে আপন কক্ষপথে সূর্যের চারদিক ঘুরতে (বার্ষিকগতি) পৃথিবীর লাগে ৩৬৫ দিন। কক্ষপথে এ ঘূর্ণনের ফলে বিভিন্ন ঋতুর আগমন হয়। ফলে মানুষ তার উপযোগী ফলফলাদি শাকসবজি পেয়ে খাদ্য চাহিদা মেটায় ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে। দৈনিক ঘূর্ণন ও কক্ষপথে পরিভ্রমণের ফলে দিনরাত হচ্ছে, ৩৬৫ দিনে কোন তারিখে কয়টায় সূর্য উঠবে, কয়টায় অস্ত যাবে তার রয়েছে নির্দিষ্ট সময়, এক সেকেন্ড সময়ও ব্যতিক্রম হয় না। এ কারণে রমজানের শুরুতেই পেয়ে যাই পুরো মাসের সেহরি-ইফতারের সময়সূচি। এমনকি এর ফলেই তৈরি করা সম্ভব হয়েছে চিরস্থায়ী ক্যালেন্ডার। শুধু পৃথিবী নয় চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, তারকা, ধুমকেতু সবাই মহাশূন্যে আপন কক্ষপথে ঘুরছে। কিন্তু একটির সঙ্গে অপরটির সংঘর্ষ হচ্ছে না। আল্লাহ বলেন, ‘সূর্য তার নির্দিষ্ট কক্ষপথে ভ্রমণ করে। এটা পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ আল্লাহর নিয়ন্ত্রণ। চন্দ্রের জন্য নির্ধারিত রয়েছে বিভিন্ন মঞ্জিল, অবশেষে সে খেজুর শাখার ন্যায় হয়ে যায়। সূর্যের উপযোগিতা নেই চন্দ্রকে ধরার, আর না দিন রাত্রিকে অতিক্রম করে যেতে পারে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ কক্ষপথে ভ্রমণ করছে।’ (সূরা ইয়াছিন, আয়াত : ৩৮-৪০)। যখন গ্রহ-নক্ষত্র ও কক্ষপথ সম্পর্কে মানুষের কোনো ধারণাই ছিল না তখন কোরআন সুস্পষ্টভাবে গ্রহ-নক্ষত্রের কক্ষপথে ভ্রমণের যে বর্ণনা দিয়েছে তা আল্লাহর অপূর্ব নিদর্শন।
 Web Desk
 লেখক : অধ্যক্ষ, ফুলগাঁও ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসা
 লাকসাম, কুমিল্লা

No comments:

Post a Comment